ছোটগল্প #শেষট্রেন #সেলিম
শেষ ট্রেন
সন্ধ্যে ছ'টা। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে দাঁড়িয়ে ছিল অজয়। ট্রেন ছাড়তে তখনও কিছুটা সময় বাকি। কিন্তু তার বুকের ভিতর যেন তোলপাড় চলছিল। হাতে একটা পুরনো খাম — যার উপর লেখা ছিল ‘রাজনি’।
চার বছর পর আজ অজয় আবার রাজনিকে দেখতে এসেছে। শেষ দেখা হয়েছিল সেই কলেজের দিনগুলোয়, যখন তারা দুজনেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছিল একসঙ্গে। কিন্তু সময়, সমাজ আর ভুল বোঝাবুঝির জালে হারিয়ে গিয়েছিল সব।
সেদিন রাজনির বাবা স্পষ্ট বলেছিলেন, "এই ছেলেটা তোমার জন্য নয়। ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।"
রাজনি মুখে কিছু বলেনি, শুধু একটা চিঠিটা দিয়েছিল — "অজয়, যদি ভালোবাসো, আমাকে ভুলে যাও। আমি চাই না তুমি আমার জন্য ভেঙে পরো।"
অজয় ভেঙে পরেনি, কিন্তু প্রতিটি দিন সে ভেবেছে — রাজনি কি একটিবারও ওকে মনে করে?
আজ হঠাৎ ফোনে রাজনির মেসেজ — “আমি কাল কানাডা চলে যাচ্ছি। যদি একবার দেখা করতে চাও, সন্ধ্যে ছ’টায় হাওড়ায় থাকবো।”
অজয় সেই অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছালো ছ’টা কুড়ি। আর রাজনির কোনো খোঁজ নেই।
অজয়ের চোখে জল চলে এলো। হঠাৎই কারও গলা — "অজয়…"
সে ঘুরে দেখল — রাজনি। তবে আগের সেই হাসি নেই, চোখ দুটো ক্লান্ত, যেন হাজারো কথা চাপা পড়ে আছে।
"তুই তো এলি," রাজনি বলল।
"তুই ভেবেছিলি আসব না?" অজয় জিজ্ঞেস করল।
রাজনি মাথা নেড়ে বলল, "ভেবেছিলাম, তুই চলে গেছিস অনেক আগেই।"
দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর রাজনি বলল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যাঁর সঙ্গে যাচ্ছি, ভালো মানুষ। কিন্তু তোকে… তোকে আমি কোনওদিন ভুলতে পারিনি, অজয়।”
অজয়ের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে হাসল। “ভালো থেকো, রাজনি। তোর সুখটাই তো চাইতাম সবসময়।”
ট্রেনের হুইসেল বাজল। রাজনি চোখ ফিরিয়ে বলল, “তুই থাকবি তো?”
অজয় বলল, “হ্যাঁ, আমি থাকব… তুই যাওয়ার পরেও, এই প্ল্যাটফর্মেই, মনে মনে তোকে বিদায় দিতে।”
রাজনি ট্রেনে উঠল। জানালার পাশ থেকে একবার চোখ রাখল অজয়ের দিকে। ট্রেন ছুটল… সঙ্গে ছুটে গেল দুজনের না বলা হাজারো কথা।
অজয় দাঁড়িয়ে রইল।
হাওড়া স্টেশন চিরকাল জানবে, একদিন এখানে একটা ভালোবাসা শেষ ট্রেনে চড়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছিল।
Comments